কোরাআন ও বিজ্ঞান
কোরআন হচ্ছে শেষ ওহী এবং একটি প্রমাণ, যা শুধু চৌদ্দশত বৎসর আগের আরবদের জন্য নয়, আজকের বিজ্ঞানীদের জন্যও। যারা বিংশ শতাব্দীতে বাস করছে-যা খুব শীগগিরই একবিংশ শতাব্দী হয়ে যাবে, তাদের জন্য কুরআনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হয়তোবা এটা যে, আধুনিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ আবিষ্কার ও কুরআন পরস্পর সঙ্গতিপূর্ণ, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আগের ধারণাকৃত বহু বিষয় গত বিশ বৎসরে আবিষ্কৃত হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রণী পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মরিস বুকাইলী, যিনি গভীর অধ্যয়নের ফলস্বরূপ ‘বাইবেল, কুরআন ও বিজ্ঞান’ নামক একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ে তিনি প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ে প্রাপ্ত বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্য তুলনা করেছেন। বিচার-বিশ্লেষণের পরে তাঁর সিদ্ধান্ত হচ্ছে: “পূর্ববর্তী দুটি ঐশীবাণী অর্থাৎ তাওরাত ও ইঞ্জিলের পর কুরআন অবতীর্ণ হয়। কুরআনের বাণীসমূহ যে শুধুমাত্র স্ববিরোধিতা থেকেই মুক্ত তা নয়, বাইবেলের মত এতে মানুষের কোন হস্তক্ষেপের প্রমাণ নেই। কেউ যদি নিরপেক্ষভাবে এবং বৈজ্ঞানিক বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর বক্তব্যসমূহ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে চায়, তাহলে দেখতে পাবে যে তা আধুনিক বৈজ্ঞানিক তথ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তদুপরি বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ও বাণী সেখানে রয়েছে। তারপরও এটা অচিন্তনীয় যে মুহাম্মাদের সময়ের একজন মানুষ এর রচয়িতা হতে পারে।
এতকাল যাবত যে সব আয়াতের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না, আধুনিক বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আমাদেরকে সে সবের অর্থ বোঝার ব্যাপারে সাহায্য করেছে। একই বিষয়ে বাইবেল ও কুরআনের বক্তব্যের তুলনা করলে কিছু মৌলিক পার্থক্য ধরা পড়ে। বাইবেলের বর্ণনা যেখানে বৈজ্ঞানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য, সেখানে কুরআনের বর্ণনা আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রাপ্ত জ্ঞান ও তথ্যের আলোকে সঙ্গতিপূর্ণ। উদাহরণ হিসাবে সৃষ্টিতত্ত্ব ও মহাপ্লাবনের বিষয নেওয়া যেতে পারে। ইহুদীদের মিসর-ত্যাগের ঘটনার বর্ণনায় কুরআন বাইবেলের সম্পূরক। যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারে দেখা গেছে, মূসার আমলকে চিহ্নিত করা যায় এমন সব নিদর্শন কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনার মিল প্রমাণ করছে। এছাড়া অন্য সব বিষয়ে এই দুই গ্রন্থের পার্থক্য বিরাট। যা আসলে এতদিন যাবত মুহাম্মাদ সম্পর্কে চলে আসা এই অভিযোগকেই খণ্ডন করছে যে তিনি কুরআন রচনা করেছেন বাইবেল থেকে নকল করে, কোন প্রমাণ দেওয়া ছাড়াই এসব অভিযোগ করা হতো।
মুহাম্মাদের আমলের জ্ঞানের উৎকর্ষতার আলোকে এটা ধারণাতীত যে কুরআনের বিজ্ঞান সম্পর্কিত বক্তব্য কোন মানুষের করা। সুতরাং এটা স্বীকার করে নেওয়া অত্যন্ত যথাযথ যে কুরআন শুধু অবতীর্ণ কিতাব নয়, বরং এর সঠিকত্বের নিশ্চয়তার জন্য এবং এতে বর্ণিত বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য একে বিশেষ মর্যাদার স্থান দেওয়া উচিত, কারণ কুরআনের অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা একথাই প্রমাণ করে যে এর কোন মানবিক ব্যাখ্যা অসম্ভব।”
আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সমর্থিত কিছু বক্তব্য
১। ভ্রূণসৃষ্টি ও এর বিকাশ সম্পর্কিত যথাযথ বর্ণনা:
নবী মুহাম্মাদের সময়ে এ সম্পর্কে বিরাজমান তত্ত্বের ভিতরে এরিস্টটলের এই ধারণা অন্তর্ভুক্ত ছিলো যে একটি শিশু রক্তের জমাট বাঁধা অবস্থা থেকে সৃষ্ট, যেভাবে পনীর তৈরী হয়। আঠারশ শতাব্দীতে হার্টসিকার দাবী করেন যে তিনি আদি মাইক্রোস্কোপ-এর সাহায্যে স্পার্ম এর মধ্যে প্রাথমিকভাবে গঠিত মানুষ দেখতে পেয়েছেন। কুরআন এসব কিছুই বলছে না, বরং মানবের ভ্রূণাবস্থার বিকাশের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বর্ণনা দিচ্ছে: “আমি তো মানুষকে মাটির উপাদান থেকে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক নিরাপদ আধারে স্থাপন করি, পরে আমি শুক্রবিন্দুকে পরিণত করি জমাট রক্তে, অতঃপর জমাট রক্তকে পরিণত করি পিণ্ডে এবং পিণ্ডকে পরিণত করি অস্থিপিঞ্জরে, অতঃপর অস্থিপিঞ্জরকে মাংস দ্বারা ঢেকে দিই, অবশেষে তাকে রূপ দান করি। সুনিপুণ স্রষ্টা আল্লাহ কত মহান! এরপর তোমরা অবশ্যই মৃত্যুবরণ করবে। অতঃপর কিয়ামতের দিন তোমাদের পুনরুত্থিত করা হবে।” (সূরা আল মু’মিনুন, ২৩, ১২-১৬)
নবী (সঃ) আরো ব্যাখ্যা করেন যে “নুতফা” পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণু উভয়টিকেই বোঝায়। “আলাকা” শব্দটির তিনটি অর্থ আছে আরবীতে: (১) আঁকড়ে থাকা বস্তু, (২) জমাট রক্তবিন্দু, (৩) জোঁকের মত বস্তু। তিনটি অর্থই বিকাশমান ভ্রূণের প্রথম ধাপকে সঠিকভাবে বর্ণনা করে। নিষিক্ত ডিম্বাণু এমন হয় যে তা জরায়ূর দেওয়াল আঁকড়ে ধরে রাখে। তারপর আকার ও আচরণের দিক থেকে সেটা জোঁকের সাদৃশ্য অবলম্বন করে। জোঁক এবং ভ্রূণ উভয়েই রক্ত শোষণ করে। এটা জমাট রক্তবিন্দুর মতও হয়ে থাকে। পরবর্তী স্তরে এটা চিবানো-বস্তুর মত হয় দেখতে, এটাও সঠিক। এটাও সত্যি যে পেশী ও মাংসের পূর্বে অস্থি তৈরী হয়। রাসূলের হাদীসে এসেছে: “যখন বিয়াল্লিশ দিন পার হয়, আল্লাহ একজন ফেরেশতা পাঠান যখন সে ভ্রূণকে আকার দান করে, এর কান, চোখ, চামড়া, মাংস এবং হাড় তৈরী করে। তারপর সে জানতে চায়, “হে রব, এটা কি পুরুষ অথবা নারী? এবং তোমাদের প্রভু স্থির করেন যা তিনি চান এবং তখন ফেরেশতারা তা লিখে নেয়।” (সহীহ মুসলিম; অধ্যায়ঃ কদর; হাদীস নংঃ ৬৩৯৩)
এই যথাযথ তথ্য বর্ণিত দিকগুলির বিকাশের সঠিক সময় জানাচ্ছে এবং ভ্রূণের লিঙ্গ ঠিক বিয়াল্লিশ দিনের পূর্বে সুনিশ্চিত ভাবে জানা সম্ভব নয়। মাত্র কয়েক দশক পূর্বেও শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপ আবিষ্কারের আগে এটা জানা সম্ভব ছিল না। শীর্ষস্থানীয় ভ্রূণতত্ত্ববিদগণের অন্যতম কিথ মুর, কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, কুরআনের এই সমস্ত বক্তব্য ও সহীহ হাদীসের বক্তব্য সম্পর্কে বলেন, “উনিশ শতক পর্যন্ত, মানবীয় বিকাশের ধাপগুলি সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। উনিশ শতকের শেষ দিকে বর্ণমালার প্রতীকের উপর ভিত্তি করে মানব ভ্রূণের বিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিত করা হয়। বিশ শতকে সংখ্যার সাহায্যে এর ২৩টি ধাপ বর্ণনা করা হয়। এই সংখ্যার সাহায্যে চিহ্নিতকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করা সহজ নয় এবং একটি ভালো পদ্ধতি হবে অঙ্গসংস্থান বিদ্যার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা পদ্ধতি। সামপ্রতিককালে কুরআনের অধ্যয়নের ফলে ভ্রূণবিকাশের বিভিন্ন ধাপ চিহ্নিতকরণের আর একটি পদ্ধতি প্রকাশিত হয়েছে যা এর সহজবোধ্য আকৃতির পরিবর্তন ও নড়াচড়ার উপর ভিত্তি করে তৈরী। এখানে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, তা আল্লাহ জিবরাইলের মাধ্যমে রাসূল (সঃ) কে জানিয়েছেন এবং তা কুরআনে লিপিবদ্ধ হয়েছে…. এটা আমার কাছে পরিষ্কার যে এসব বক্তব্য নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছ থেকে মুহাম্মাদ (সঃ) এঁর কাছে এসেছে কারণ এই জ্ঞানের প্রায় সবটুকুই অবিষ্কৃত হয়েছে এর বহু শতক পরে। এটা আমার কাছে প্রমাণ করছে যে মুহাম্মাদ নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূল।”
ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান এবং ফিলাডেলফিয়ারটমাস জেফারসন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল বাও ইনস্টিটিউটের পরিচালক মার্শাল জনসন বলেন, “বিজ্ঞানী হিসাবে আমি সেসব বস্তু নিয়ে কাজ করি যা আমি নির্দিষ্টভাবে দেখতে পারি। আমি ভ্রূণতত্ত্ব এবং ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজি বুঝতে পারি। আমি কুরআনে যে শব্দগুলি আমার কাছে অনুবাদ করে দেওয়া হয়েছে তা বুঝতে পারি। আমাকে যদি আমার আজকের জ্ঞান ও বর্ণনার যোগ্যতা সহকারে সেই যুগে স্থানান্তর করা হয়, আমি ব্যাপারগুলি যেভাবে বর্ণনা করা আছে সেভাবে বর্ণনা করতে পারব না। আমি এটা প্রত্যাখ্যানের কোন কারণ দেখি না যে মুহাম্মাদ এই তথ্য অন্য কোথাও থেকে পেয়েছেন, সুতরাং আমি এই ধারণার সাথেও সাংঘর্ষিক কিছু দেখতে পাই না যে তিনি যা বলেছেন তাতে ঐশী হস্তক্ষেপ রয়েছে।”
২। মহাকাশবিজ্ঞান:
“অবিশ্বাসীরা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল; অতঃপর আমি উভয়কে পৃথক করে দিলাম; এবং জীবন্ত সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম; তবুও কি তারা বিশ্বাস করবে না?” (সূরা আল আম্বিয়া, ২১:৩০)
এই আয়াতটি বিশ্বের উৎপত্তির সাধারণ তত্ত্ব বর্ণনা করছে, যে সত্য আজ থেকে চল্লিশ বছর আগেও নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার সূচনার আগে আবিষ্কৃত হয়নি। এখানে যে পৃথক করার বলা হয়েছে তা বিজ্ঞানীদের কথিত “বিগ-ব্যাং” তত্ত্বের অনুরূপ। তাছাড়া, সমস্ত জীবিত প্রাণী প্রটোপ্লাজম দিয়ে তৈরী যার ৮০-৮৫% ভাগই পানি।
“অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রপুঞ্জ বিশেষ। অনন্তর তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বললেন, ‘তোমরা উভয়ে আমার আদেশ পালনের জন্য ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় প্রস্তুত হও।’ তারা বলল, ‘আমরা তো অনুগত থাকতে পস্তুত আছি।” (সূরা আল ফুসসিলাত, ৪১:১১)
এখানে ধূম্রপুঞ্জ শব্দটি বিশ্বের আদিম অবস্থার সঠিক বর্ণনা দিচ্ছে, যা ছিল গরম গ্যাসের পিণ্ড যাতে বস্তুকণা দ্রুত ছোটাছুটি করছে, ধোঁয়ার মত। এ থেকে গ্রহ, নক্ষত্র ও পৃথিবী তৈরী হয়। “আমি আমার ক্ষমতাবলে আকাশ নির্মাণ করেছি এবং আমিই একে সমপ্রসারিত করছি।”(সূরা আয যারিয়াত, ৫১:৪৭)
এটা একটা স্বীকৃত সত্য যে আমরা যে বিশ্বে বাস করছি তা সমপ্রসারণশীল। “আল্লাহই দিন এবং রাত তৈরী করেছেন, এবং চাঁদ ও সূর্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ গতিতে কক্ষপথে সাঁতার কাটছে/ঘুরছে।”
নিজ গতিতে চলার জন্য যে আরবী শব্দ ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে সাবাহাহ্ (এই আয়াতে ইয়াসবিহুনা)। এটা এমন গতি নির্দেশ করছে যা বস্তুর নিজের। যদি এটা পানিতে ঘটত, তাহলে এটা হত সাঁতার কাটা; এটা সেই নড়াচড়া যা একজনের পায়ের মাধ্যমে হয়। মহাশূন্যে নড়াচড়ার সময় এটা হবে নিজের অক্ষের উপর ঘুরে যাওয়া। সূর্য নিজের কক্ষপথে পৃথিবীর চারপাশে নয়, বরং ছায়াপথের কেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে, সুতরাং এখানে কোন বৈপরীত্য নেই, কারণ কুরআন সূর্যের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করেনি। “তুমি কি দেখ না আল্লাহ রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন করেন?” (সূরা আল লুকমান, ৩১:২৯) “তিনি রাত্রি দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।” (সূরা আয যুমার, ৩৯:৫)
পেঁচানো বা জড়ানো আরবী শব্দ কাওওয়াররার অনুবাদ। এর মূল অর্থ হচ্ছে মাথার চারপাশে পাগড়ী পেঁচিয়ে বাঁধা। অবিরত পেঁচানোর পদ্ধতি-যাতে এক অংশ আরেক অংশের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, কুরআনে এমনভাবে বলা হয়েছে যে মনে হয় সে সময়ে পৃথিবীর গোলাকৃতি হওয়ার ধারণার সাথে মানুষ পরিচিত ছিল, যা স্পষ্টতঃই সত্য নয়। “তিনিই সূর্যকে তেজষ্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তার তিথি নির্দিষ্ট করেছেন…” (সূরা ইউনুস, ১০:৫)
কুরআনে সূর্যকে “সিরাজ” হিসাবে বলা হয়েছে যার অর্থ হচ্ছে “মশাল” যা নিজের তাপ ও আলো উৎপন্ন করে যেখানে চন্দ্রকে “নূর” বা আলো হিসাবে বলা হয়েছে যার অর্থ অন্য উৎস থেকে নেয়া আলোর আভা।
৩। ভূতত্ত্ব:
“আমি কি ভূমিকে বিছানা ও পর্বতকে কীলক সদৃশ করিনি?” (সূরা আন নাবা’, ৭৮:৬-৭)“আল্লাহই পৃথিবীতে পর্বতমালা স্থাপন করেছেন যাতে এ তোমাদের নিয়ে ঢলে না পড়ে।” (সূরা আল লুকমান, ৩১:১০)
সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে যে পর্বতমালার মূল ভূত্বকের ভিতরে চলে গেছে যা সাতটি টেকটোনিক প্লেট দিয়ে গঠিত। এই প্লেটগুলির নড়াচড়াই ভূমিকম্পের কারণ। এটা ধারণা করা হচ্ছে যে এই মূল ও পর্বতের ওজন ভূত্বকের স্থিতিশীলতার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪। প্রাণী ও উদ্ভিদ জগত:
কুরআনের ষষ্ঠতম পারায় বলা আছে যে মধু সংগ্রহকারী মৌমাছি হচ্ছে স্ত্রী মৌমাছি; যদিও এটা সাধারণ ধারণা যে মৌমাছিরা সৈনিক এবং তারা রাজার অধীন। কুরআনে আরো বলা আছে যে উদ্ভিদের মাঝেও স্ত্রীপুরুষ রয়েছে এবং বায়ুর সাহায্যেও উদ্ভিদের প্রজনন ঘটে থাকে। “আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু প্রেরণ করি।” (সূরা আল হিজর, ১৫:২২)
এগুলি সবই সামপ্রতিককালে আবিষ্কৃত হয়েছে।
৫। পরমাণু বিজ্ঞান:
গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস (৪৬০-৩৬১ খৃ.পূ.) এই তত্ত্বের উদ্গাতা যে বস্তু ছোট অবিভাজ্য কণা দিয়ে তৈরী, যার নাম এটম। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করেছে যে এটম আছে, তবে তা বিভাজ্য। কুরআন বলছে: “তিনি অদৃশ্য সম্বন্ধে সম্যক পরিজ্ঞাত, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে অণু-পরিমাণ কিছু কিংবা তদপেক্ষা ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ কিছু যাঁর অগোচর নয়।” (সূরা সাবা, ৩৪:৩)
৬। ত্বক বিজ্ঞান:
“মানুষ কি মনে করে যে আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করতে পারব না? বস্তুত আমি তার অঙ্গুলির অগ্রভাগ পর্যন্ত পুনর্বিন্যস্ত করতে সক্ষম।” (সূরা আল ক্বিয়ামাহ, ৭৫:৩-৪)
কোন দুটি আঙ্গুলের ছাপ একরকম নয়। [সংকলক – দুইটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ এক রকম না হওয়ায়, এই বৈশিষ্ট্যকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ভেরিফিকাশন নামে অন্যতম সিকিউরিটি অথেন্টিক্যাশেন মেথড হিসেবে বর্তমানে ব্যবহত হচ্ছে।] এই আয়াতে আমাদের পুনর্জীবিত করার আল্লাহর জ্ঞান ও ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে যা সবচেয়ে একক ও স্বতন্ত্র অঙ্গ পর্যন্ত করা হবে। “যারা আমার আয়াতকে অবিশ্বাস করে তাদের আগুনে দগ্ধ করবই। যখনই তাদের চর্ম দগ্ধ হবে তখনই তার স্থলে নতুন চর্ম সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করে। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সূরা আন নিসা, ৪:৫৬)
যেসব স্নায়ুপ্রান্ত বেদনা বোধ করে তা চামড়ায় রয়েছে। যখন চামড়া মারাত্মকভাবে পুড়ে যায়, তখন স্নায়ুপ্রান্ত ধ্বংস হয়ে যায় ও বেদনা আর টের পাওয়া যায় না। জাহান্নামে আল্লাহ পুনরায় চামড়া সৃষ্টি করবেন যাতে তার অধিবাসীরা স্থায়ীভাবে তীব্র ব্যথা অনুভব করে। “নিশ্চয়ই যাক্কুম বৃক্ষ হবে পাপীর খাদ্য; গলিত তাম্রের মত তা উদরে ফুটতে থাকবে, ফুটন্ত পানির মত।’ ‘আস্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো ছিলে সম্মানিত, অভিজাত। তোমরা তো এ শাস্তি সম্পর্কে সন্দিহান ছিলে।’ (সূরা আদ দুখান, ৪৪:৪৩-৫০)
“…এবং যাদের পান করতে দেওয়া হবে ফুটন্ত পানি যা তাদের নাড়িভুড়ি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে।” (সূরা মুহাম্মাদ, ৪৭:১৫)
অন্ত্রে তাপ বহনকারী ধারক থাকে না। এটা জানা আছে যে, যদি নাড়িভুঁড়ি কেটে যায় তাহলে এর ভিতরের উপাদানসমূহ উচ্চ সংবেদনশীল পেরিটোনিয়া ক্যাভিটিতে চলে যায়, যেখানে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এটা বর্তমানের প্রচলিত জ্ঞান নয়, মুহাম্মাদের সময়ের তো নয়ই। সে যাই হোক, কুরআনের রচয়িতা এসব সত্যের সাথে সুপরিচিত!
৭। পানি চক্র:
কুরআনে সঠিকভাবে পানি চক্রের বর্ণনা দেওয়া আছে এবং ভূগর্ভের ঝরণার পানির উৎস হিসাবে বৃষ্টির পানিকে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক প্রতীয়মান হলেও গ্রীক দার্শনিকগণ এটা মনে করতেন না, তাঁরা ভাবতেন মাটির তলার ঝর্ণাধারা তৈরী হত সমুদ্রের পানির ধারা গুহায় জমে গিয়ে, যা বিরাট পাতালের সমুদ্রে গহ্বরের মাধ্যমে সরবরাহ হতো। আসলে অষ্টাদশ শতকের পূর্বে পানি চক্র সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অথচ কুরআন এদিকে বলছে, “তুমি কি দেখনা, আল্লাহ আকাশ থেকে বারিবর্ষণ করেন, অতঃপর ভূমিতে স্রোতরূপে প্রবাহিত করেন?” (সূরা আয যুমার, ৩৯:২১)
সংক্ষিপ্ত রাখতে গিয়ে আমি শুধু কয়েকটি বক্তব্যের উল্লেখ করেছি এবং বিজ্ঞান বিষয়ক কুরআনের বক্তব্যের ও হাদীসের বর্ণনার সীমাবদ্ধ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছি। কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন ও ডেন্টিস্ট্রির এনাটমি বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যানটি.ভি.এন পারসাদ বলেছেন, “মুহাম্মাদ একজন সাধারণ লোক ছিলেন, তিনি পড়তে জানতেন না, লিখতে পারতেন না, আসলে তিনি নিরক্ষর ছিলেন…আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছি তা হল যে চৌদ্দশত বছর পূর্বে কিছু নিরক্ষর লোক গভীর কিছু উচ্চারণ করেছিল ও বক্তব্য দিয়েছিল যা বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক। আমি ব্যক্তিগতভাবে বুঝতে পারি না এটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা কিভাবে হতে পারে, এতে অসংখ্য অত্যন্ত সঠিক ব্যাপার রয়েছে… আমার মনে কোন সংশয় নেই এই সত্য স্বীকার করতে যে কোন ঐশী প্রেরণা বা ওহী তাঁকে এই বক্তব্যগুলি দিতে নির্দেশ দিয়েছে। আমরা যেন ড. মরিস বুকাইলির কথাগুলি ভুলে না যাই যে এই সত্যগুলো “মানবীয়ভাবে ব্যাখ্যার ব্যাপারে একটি চ্যালেঞ্জ।”
এবং প্রফেসর পারসাদ এর বিবৃতি যে এটা হঠাৎ ঘটে যেতে পারে না, এখানে অসংখ্য সঠিক তথ্য রয়েছে! মুহাম্মাদের জন্য অনুমান করা এবং প্রতিটি সঠিক হওয়ার সম্ভাব্যতা আসলেই বিস্ময়কর। এ সমস্ত বিজ্ঞানীরা, যাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপরিচিত, সেই আরবদের মত যারা তাদের ভাষা পাণ্ডিত্য সহকারে আয়ত্ব করেছিল মুহাম্মাদের সময়ে, স্পষ্ট প্রমাণ চিনতে পারেন এবং কুরআনের প্রকৃতির অলৌকিকত্ব অনুধাবন করতে পারেন। “আমরা তাদেরকে আমাদের নিদর্শন দেখাবো দূর দিগন্তে এবং তাদের মধ্যে যতক্ষণ না তারা জানতে পারে যে এটাই সত্য।”
কুরআন বাহ্যিক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এবং আভ্যন্তরীণের সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ। অসঙ্গতি ও বৈপরীত্য রয়েছে আসলে মানুষের কাজের প্রকৃতিতে, তা তারা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাধু অথবা সূফী যাই হোক না কেন। এটা ঐশী ওহীর জন্য সত্য হতে পারে না, যেমন কুরআন বলছে, “তারা কি সতর্কতার সাথে কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না, যদি এটা আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছ থেকে হতো, তারা এতে বহু অসামঞ্জস্য খুঁজে পেতো।
Comments
Post a Comment